আলোকিত সকাল ডেস্ক
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে হতাশ ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা। এক যুগের বেশি সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে থাকলেও এখন শরিকদের একাধিক দল জোট ছাড়ার বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। কেউ আবার এই মুহূর্তে জোট না ছেড়ে ‘জোট করব, দলও গোছাব’ নীতি নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জোটগত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি সংসদ ও সংসদের বাইরে সরকারের ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ও করবে ১৪ দলের একাধিক শরিক। কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে ১৪ দলের শরিক দলগুলোর বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা এমনটা জানিয়েছেন।
১৪ দলের শরিক দলগুলোর ওই নেতাদের মতে, ১৪ দল গঠন হয়েছিল বিএনপি-জামায়াতকে মোকাবেলা করতে। বর্তমানে এ দল দুটি রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের বিরোধিতার রাজনীতির ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়ে এসেছে। এতে আওয়ামী লীগ এখন আর ১৪ দলের শরিকদের তেমন কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিশেষ করে বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ জোটগত পথে না গিয়ে নিজেদের দলীয় সরকার গঠন করায় হতাশ হয়েছেন জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ, জাতীয় পার্টি-জেপি, সাম্যবাদী দলসহ কয়েকটি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা।
অন্যদিকে ২০০৫ সালে ১৪ দল গঠনের পর থেকে বিগত ১৪ বছরে জোটে থেকেও সাংগঠনিকভাবে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি ছোট দলগুলো। ফলে তারাও এখন জোটে থাকা না থাকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে।
গত শুক্রবার তোপখানা রোডে বাংলাদেশ জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির এক সভায় বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর দেশে বিচলিত হওয়ার মতো রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে বলে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভা থেকে গৃহীত প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, ‘বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বিষণ্ন পরিস্থিতিতে দেশে বিচলিত হওয়ার মতো এক রাজনৈতিক শূন্যতা দৃশ্যমান হয়েছে বলে এ সভা মনে করে। ১৪ দল তথা মহাজোটের সরকার সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের একক দলীয় সরকারে পরিণত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক পদ্ধতিতে হওয়ার প্রবণতা ক্রমহ্রাসমান হয়ে এখন তা প্রশাসনের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে। এ গোষ্ঠীটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতিটি বিষয়, এমনকি নারী নির্যাতন মোকাবেলার মতো দৈনন্দিন করণীয় নির্ধারণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমগ্র প্রক্রিয়াকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী করে ফেলেছে। এর আড়ালে প্রশাসনের বিশেষ ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটি গণতন্ত্রকে বাক্সবন্দি করতে চাইছে, যা সাংবিধানিক ও সংসদীয় পদ্ধতিকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে।’
প্রস্তাবে আরো বলা হয়, ‘জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ-বহির্ভূত সংসদ সদস্যদের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য দেওয়া নোটিশকে উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদে সমালোচনামূলক আলোচনার সুযোগও সীমিত করে ফেলা হচ্ছে। অপর পক্ষে সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও অদৃশ্য শক্তিনির্ভর বিএনপি-জামায়াত জোট জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক আশঙ্কাজনক রাজনৈতিক শূন্যতা। গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা বিপত্সংকেত।’
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এখন আমাদের দলীয় কর্মকাণ্ডে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে আমরা ১৪ দল গঠন করেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে তারা কোণঠাসা। এত দিন যাদের বিরোধিতা করতাম তারা এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে এখন তেমন লাভ নেই। সে জন্য আমরা দল গোছানো ও সংসদের ভেতরে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনাকে গুরুত্ব দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দল গোছানোর কাজে গুরুত্ব দিচ্ছি। রমজানে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আমাদের কর্মিসভা ও ইফতার মাহফিল হবে। আগামী অক্টোবরে আমাদের জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে আমরা দলকে সংহত করব।’
জাতীয় পার্টি-জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৪ দলের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। আমাদের এই ঐক্য থাকবে। কিন্তু সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা আমরা করছি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, টক শোতে আমরা দুর্নীতি, আওয়ামী লীগের হাইব্রিড বা ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় কাউয়াদের বিরুদ্ধে কথা বলছি।’
বিগত জাতীয় নির্বাচনের পরের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জেপির ভূমিকা কী হবে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রী শেখ শহীদ বলেন, ‘ঈদের পর আমাদের জাতীয় কাউন্সিলে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে আমাদের করণীয় চূড়ান্ত করব।’
ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৪ দলের উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা কী সেটা এখন জনগণের কাছে স্পষ্ট করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া জোটের মধ্যে মান-অভিমান, জোটে থাকা-না থাকার বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। ১৪ দলের শরিকরা বিরোধী দলে যেতে রাজি হয়নি। আবার জোটের কর্মকাণ্ডও আগের মতো সক্রিয় নেই। আমার ধারণা, সামনে একটি নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হবে। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন আমরা সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কাজের বিরোধিতা করব। তবে জোটও করব, আবার দলও গোছাব।’
বাসদের (মাহবুব) আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৪ দল গঠনের সময় কথা ছিল একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠন। কিন্তু এবারে জোটগত সরকার গঠন হয়নি। কিন্তু এ কারণে ১৪ দল ভেঙে যাবে না। তবে আমরা জোটের সঙ্গে থাকলেও সরকারের দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক শাসন কায়েমের বিরোধিতা করে যাব।’
এক যুগেরও বেশি সময় জোটে থেকে সাংগঠনিক কাজে ক্ষমতায় থাকার কোনো সুবিধা পাননি জানিয়ে রেজাউর রশীদ খান বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে ৩৮টি জেলায় কমিটি করেছি। কিন্তু এ কাজে ক্ষমতাসীনদের কোনো সহযোগিতা বা সহমর্মিতা পাইনি।’
আস/এসআইসু