মা কথাটি ছোট্ট অতি

আলোকিত সকাল ডেস্ক

মায়ের বিশালত্ব কোনো কিছু দিয়েই পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যে যে আবেগ আর আত্মার সম্পর্ক লুকিয়ে আছে, খ্যাতিমান কবি কাজী কাদের নেওয়াজ তার ‘মা’ কবিতায় কিছুটা হলেও তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

আগামীকাল রবিবার ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর নিউজ ফিড ভরে উঠবে মা-সন্তানের ছবিতে। এদিন বিশ্ব মা দিবস। দেশে দেশে উদযাপন হবে দিবসটি। বছরের প্রতিটি দিবস মায়ের জন্য হলেও সমস্যা নেই। তারপরেও জন্মদাত্রীর জন্য যদি একটি দিন সারাবিশ্বের মানুষ একযোগে পালন করেন তাতেও দোষের কিছু নেই। একজন মানুষের পৃথিবীতে যে অস্তিত্ব তার পেছনে আছে একজন মায়ের দীর্ঘ নয় মাসের এক কষ্টসহিষ্ণু কাল। তাই মায়ের অবস্থান সবার উপরে। তার চেয়ে আপন আর কেউ নেই। সন্তানের কাছে তিনিই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠা।

মা দিবসের সূত্রপাত ১৯০৮ সালের ৮ই মে। সঙ্গে উপহার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সাদা কার্নেশন ফুল। সমীক্ষা বলছে, বছরের আর পাঁচটা দিনের তুলনায় এদিন অনেক বেশি মানুষ নিজের মাকে ফোন করেন, তাঁর জন্য ফুল কেনেন, উপহার দেন। মায়ের বুকের হূদস্পন্দন সন্তানের কাছে সবচে পরিচিত। মায়ের বুকের দুধে, শরীরের উষ্ণতায় সবার বেড়ে ওঠা। সন্তানের কাছে ‘মা’ ডাকটি যেমন সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আপন, তেমনি একজন মায়ের কাছেও সন্তানের মুখ থেকে ‘মা’ ডাক শোনাটি সবচেয়ে ভালো লাগার মুহূর্ত। তাই ‘মা’ কে নিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা যত কবিতা লিখেছেন, যত গান রচিত হয়েছে এমনটা আর কাউকে নিয়েই হতে দেখা যায় না। মা-কে ঘিরে যে আবেগ তার যেন শেষ নেই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা বহমান।

সন্তানকে বড় করবার জন্য একজন মা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা উত্সর্গ করেন। খুব মেধাবী একজন নারী, একজন চাকরিজীবী তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা সন্তান জন্ম দেওয়া ও তার লালনে ব্যয় করেন। এর জন্য চাকরিতে ব্যবসায় তিনি পিছিয়ে পড়েন সমসাময়িক অন্যদের থেকে। কিন্তু সেই কষ্ট তিনি নির্দ্বিধায় মেনে নেন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে।

সাম্প্রতিক সময়ে সন্তানদের বিপথে চলে যাওয়া, জঙ্গি হওয়ার পেছনে পারিবারিক সম্পর্ক শিথিল হওয়ার কথা বলছেন সমাজবিদরা। এ পরিস্থিতিতে সন্তানকে সঠিক মূল্যবোধ শিক্ষায় মায়ের গুরুত্ব যে সবচেয়ে বেশি সে কথাও বলছেন তারা। সব ধর্মে মায়ের অবস্থান সবার উঁচুতে স্থান দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত’। খ্রিষ্টধর্মেও রয়েছে ‘মাদার মেরির’ বিশেষ তাত্পর্য। উপনিষদে আছে, ‘মাতৃ দেব ভব’। অর্থাত্ মা দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত ঈশ্বরী। তাছাড়া হিন্দুধর্মে মহাশক্তি, আদিশক্তি, রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় যাদের দেখা যায়, তারা মাতৃরূপেই পরিচিত।

দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক সন্তানই মায়ের ত্যাগের কথা ভুলে যায়। আজকাল অনেক ছেলেমেয়েকেই মা-বাবার অযত্ন করতে, তাঁদের অবহেলা করতে দেখা যায়। তাঁদের রক্ত-মাংসে বেড়ে ওঠা সন্তানটি সব ভুলে মা-বাবাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।

দেশে দেশে ‘মা’ : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহূত ‘মা’ ডাকের শব্দগুলোর মধ্যকার উচ্চারণগত এই সাদৃশ্য কীভাবে ঘটল তা এক বিরাট রহস্য। তবে ভাষাবিদ রোমান জ্যাকবসন এর পেছনে যুক্তি দেখিয়েছেন যে- শিশুরা যখন তার মায়ের দুধ পান করে, তখন তারা তাদের মুখভর্তি অবস্থায় কিছু শব্দ করে। সেই শব্দগুলো নাক দিয়ে বের হয় বলে উচ্চারণগুলো অনেকটা ‘ম’ এর মতো শোনা যায়। তাই প্রায় সব ভাষায়ই ‘মা’ ডাকে ব্যবহূত শব্দগুলো ‘ম’ বা ‘এম’ দিয়ে শুরু হয়। মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ‘মা’ বোঝাতে ব্যবহূত শব্দগুলোর উচ্চারণ প্রায় কাছাকাছি। জার্মান ভাষায় ‘মাট্টার’, ওলন্দাজ ভাষায় ‘ময়েদার’, ইতালিয়ান ভাষায় ‘মাদর’, চীনা ভাষায় ‘মামা’, হিন্দি ভাষায় ‘মা’, প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় ‘মাত’, সোয়াহিলি ভাষায় ‘মামা’, আফ্রিকান ও বাংলা ভাষায় ‘মা’ একথার বড় উদাহরণ।

যেভাবে এলো মা দিবস:বর্তমানে প্রচলিত মা দিবসের সূচনা হয় ১৯০৮ সালে। গত শতাব্দীর শুরু দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক স্কুলশিক্ষিকা অ্যানা জারভিস সেখানকার পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা দেখে মর্মাহত হয়ে মায়ের জন্য বিশেষ দিন পালনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করার কথা ভাবলেন। তার সে ভাবনা বাস্তবায়নের আগে ১৯০৫ সালের ৯ মে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর মেয়ে অ্যানা এম জারভিস মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেন। বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ১৯০৮ সালে তার মা ফিলাডেলফিয়ার যে গির্জায় উপাসনা করতেন, সেখানে সব মাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মা দিবসের সূচনা করেন। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মায়েদের জন্য উত্সর্গ করে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দিবসটি পালন করা হয়।

তবে অনেকের মতে এই দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রিসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে। যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশ্যে করা সেই আরাধনা পরিণত হয়েছিল উত্সবে। প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উত্সর্গিকৃত আরো একটি ছুটির দিন ছিল। সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়ার চল ছিল। মাদারিং সানডের মতো ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে বহু আচার অনুষ্ঠান পালিত হত। একটি নির্দিষ্ট রবিবারে মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য সে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হত। মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিষ্টানদের প্রথা যা ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতা ও প্রধান গির্জার সম্মানে পালিত হয়। প্রথা অনুযায়ী দিনটিতে প্রতীকী উপহার দেওয়া এবং রান্না ও অন্য যেসব কাজ মেয়েরা করে সেসব কাজ অন্য কেউ করে মেয়েদের সম্মান জানাতো।

তবে, জুলিয়া ওয়ার্ড হোই রচিত ‘মাদার্স ডে প্রক্লেমেশন’ বা ‘মা দিবসের ঘোষণাপত্র’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস পালনের গোড়ার দিকের প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ১৮৭০ সালে রচিত হোই-এর মা দিবসের ঘোষণাপত্রটি ছিল একটি শান্তিকামী প্রতিক্রিয়া। রাজনৈতিক স্তরে সমাজকে গঠন করার ক্ষেত্রে নারীর একটি দায়িত্ব আছে, হোই-এর ঘোষণাপত্রের এটিই ছিল মূল বিষয়। ১৯১২ সালে আনা জার্ভিস স্থাপন করেন মাদার’স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন এবং মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস পালনে প্রচারণা শুরু করেন।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা ‘মাকড়সা’ :মা সন্তানের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দেয় সন্তানের বেঁচে থাকার এবং মঙ্গল কামনার জন্য এ চিরন্তন সত্যটি শুধু মানুষের মাঝেই নয়, প্রকৃতির অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এটি সত্যি। তেমন এক প্রাণীর নাম মাকড়সা। মাকড়সার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মা মাকড়সা সেই ডিম নিজের দেহে বহন করে যায় বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত। যখন বাচ্চা হয় তখন মা মাকড়সা বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজের শরীর বিলিয়ে দেয় তাদের খাবারের জন্য। বাচ্চা মাকড়সারা মা মাকড়সার দেহ খেতে শুরু করে ঠুকরে ঠুকরে। সন্তানের জন্য মা নীরবে হজম করে সব কষ্ট-যন্ত্রণা। এমনি করে এক সময় মায়ের পুরো শরীরটাই চলে যায় সন্তানদের পেটে। সন্তানদের জন্য মা মাকড়সার এ আত্মত্যাগের কারণেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মায়ের তালিকায় মাকড়সার স্থান অনেক ওপরে।

আস/এসআইসু

Facebook Comments Box