আলোকিত সকাল ডেস্ক
আয়ারল্যান্ডের মাটিতে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে আগামীকাল শুক্রবার (১৭ মে) ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। এ নিয়ে সপ্তমবারের মতো কোনো ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল খেলতে চলেছে টাইগাররা। আগের ছয়বার ট্রফি ছোঁয়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও তা অধরাই থেকে গেছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের। তবে সপ্তমবারে এসে টাইগাররা যদি তরী ডোবাতে না চায়, সেক্ষেত্রে দলের আদর্শ হতে পারেন স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস!
বহু বছর আগের কথা। টানা ৬বার যুদ্ধে হেরে গিয়ে রবার্ট ব্রুস রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। একে তো যুদ্ধে নিহত হয়েছিল তার অনেক সেনা, তার মধ্যে আবার হয়েছিলেন রাজ্য হারা। প্রতিপক্ষের আক্রমণের শঙ্কায় ও নিজের প্রাণ বাঁচাতে তিনি আত্মগোপন করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। পালাতে পালাতে একসময় রবার্ট ক্রুস একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সেখানেই তিনি দিন যাপন করতে থাকেন।
একসময় তিনি গুহায় একটি মাকড়সা দেখতে পেলেন। তিনি দেখতে লাগলেন মাকড়সাটি তারই বানানো জালে বারবার লাফিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকলেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। টানা ছয়বার ব্যর্থ হওয়ার পর সপ্তমবারে এসে মাকড়সাটি তার কর্ম সম্পাদনে সক্ষম হলো। আর ব্রুসও এই দৃশ্য দেখে বেশ অনুপ্রাণিত হলেন এবং যুদ্ধে ছয়বার হারের পরও সপ্তমবারের মতো যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। পরবর্তীতে স্কটিশ সম্রাট সৈন্য জোগাড় করতে থাকলেন এবং একসময় সম্পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন।
টানা ৬ বার হারের তিক্ত স্বাদ থেকে বের হয়ে রণক্ষেত্রে ঠিকই বিজয় লাভ করে ইতিহাসের পাতায় অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন রবার্ট ব্রুস। বাংলদেশও এখন কিন্তু ঠিক তেমন এক নজির গড়ার দ্বারপ্রান্তে!
২০০৯ সালে দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো কোনো ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল খেলেছিল বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হার সত্ত্বেও তখনকার শক্তিশালী দল শ্রীলঙ্কাকে বোনাস পয়েন্টসহ হারিয়ে দিয়ে ফাইনালে চলে যায় টাইগাররা। লঙ্কানদের বিপক্ষে সাকিব আল হাসানের ঝড়ো ৯৩ রানের অপরাজিত ইনিংসটি বাংলাদেশকে ফাইনালে নিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। ফাইনাল ম্যাচে আগে ব্যাট করতে নেমে মোটেও সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ। মাত্র ১৫২ রানেই শেষ হয় তাদের ইনিংস।
তবে মাত্র ৬ রানে শ্রীলঙ্কার ৫ উইকেট পড়ে যায়, যা ছিল ওয়ানডেতে সবচেয়ে কম রানে কোনো দলের ৫ উইকেটের পতন। শেষদিকে জয়ের জন্য শ্রীলঙ্কার দরকার ছিল ২ ওভারে ৩৩ রান। কিন্তু রুবেল হোসেনের করা ৪৯তম ওভারে লঙ্কান কিংবদন্তি স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরন ব্যাট হাতে জ্বলে উঠলে ২ উইকেটে জিতে যায় শ্রীলঙ্কা।
২০১২ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। ঢাকাস্থ মিরপুরে শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে আগে ব্যাট করে পাকিস্তান ৯ উইকেটে ২৩৬ রান করে। টাইগার পেসার শাহাদাত হোসেন শেষ ওভারে ১৭ রান দিলে মাঝারি চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য টাইগারদের ছুঁড়ে দেয় পাকিস্তান। তামিম ইকবালের সঙ্গে ওপেনিংয়ে নামা নাজিমুদ্দিন ৫২ বল খেলে করেন মাত্র ১৬ রান! যা পরে বাংলাদেশের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারপরেও জয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। শেষ ওভারে ৬ বলে ৯ রান প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ম্যাচটিতে মাত্র ২ রানে হেরে মাঠেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
২০১৬ সালে আবারও এক টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে টাইগাররা। এবার টি-২০ এশিয়া কাপ। তবে আগের ফাইনালগুলোর মতো এই ফাইনালেও হারে বাংলাদেশ। এবার ভারতের বিপক্ষে হার দেখে লাল-সবুজরা। বৃষ্টির কারণে ২০ ওভারের ম্যাচ ১৫ ওভারে নেমে আসায়, বাংলাদেশ ৫ উইকেটে সংগ্রহ করতে পারে ১২০ রান। জবাবে ভারত শিখর ধাওয়ানের ফিফটি ও মহেন্দ্র সিং ধোনির দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে ভারত শিরোপা জিতে নেয় ৮ উইকেটের জয়ে।
২০১৮ সাল বাংলাদেশের জন্য ছিল আরও করুণ। এই বছর তিনটি ফাইনাল হারের ক্ষতে পোড়ে তামিম-সাকিবরা। বছরের শুরুতে দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে আগে ব্যাট করা শ্রীলঙ্কা ২২১ রানেই অলআউট হয়ে যায়। বড় রানের লক্ষ্য লঙ্কানরা ছুঁড়ে দিতে না পারায় জয়ের সুবাস পেতে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু চরম ব্যাটিং ব্যর্থতা এবং ফিল্ডিংয়ে আঙুলের ইনজুরিতে পড়ায় সাকিব আল হাসানের ব্যাটিং করতে না পারা মিলিয়ে মাত্র ১৪২ রানেই গুঁটিয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস। বৃথা যায় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ৭৬ রানের লড়াকু ইনিংস।
একই বছর শ্রীলঙ্কার মাটিতে বসা টি-টোয়েন্টি নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল বাংলাদেশ হেরে যায় একেবারে শেষ বলে। আগে ব্যাট করে বাংলাদেশ সংগ্রহ করে ৮ উইকেটে ১৬৬ রান। বল হাতেও বাংলাদেশ দারুণ করছিল। ১৮তম ওভারে কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান মেইডেন ওভারসহ ১ উইকেট তুলে নিলে শেষ ২ ওভারে ভারতের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৪ রান। ১৯তম ওভারে রুবেল হোসেন ২২ রান দিয়ে বসলে খেলার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শেষ ওভারে সৌম্য সরকারের হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক সাকিব। প্রথম ৫ বলে ৭ রান দিয়ে এক উইকেট নেন সৌম্য, তাতে শেষ বলে ভারতের দরকার ছিল ৫ রান। শেষ বলে দীনেশ কার্তিক ছক্কা মেরে ম্যাচ শেষ করে দিলে আবারো ফাইনালে হারের হতাশায় পোড়ে বাংলাদেশ।
এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে বসা এশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচে ফের বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ভারতকে। আগে ব্যাট করতে নেমে দারুণ শুরু পায় বাংলাদেশ। লিটন দাস তার প্রথম ওয়ানডে সেঞ্ছুরি তুলে নিয়ে খেলেন ১২১ রানের ইনিংস। তবে বাকি ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা এবং লিটনকে টিভি আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে স্টাম্পিং আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরার কারণে ২২২ রানেই অলআউট হয় মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার দল। ২২৩ রানের লক্ষ্যে খেলতে নামা ভারতকে অবশ্য বল হাতে ভালোভাবেই চেপে ধরেছিল বাংলাদেশ। ফলে এই ম্যাচের একেবারে শেষ বলে ভারতের জয়ের জন্য দরকার পড়ে ১ রান। রান আটকে রাখতে পারলে ম্যাচ গড়াবে সুপার ওভারে এমন অবস্থায় শেষ বলে ১ রান নিয়ে ঠিকই জয় তুলে নেয় ভারত এবং টানা ৬ ফাইনালে হারের আক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশ মাঠ ছাড়ে।
তবে এবার বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে আগের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কমই বলা যায়। লীগ পর্বের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুইবার একপেশেভাবে হারানো বাংলাদেশ শক্তিমত্তায় এগিয়ে আছে। তাই প্রথমবার কোন টুর্নামেন্টের ট্রফি জয় টাইগারদের জন্য এখন সময়ের ব্যাপারই বলা যায়। আর অনুপ্রেরণা হিসেবে রবার্ট ব্রুস তো আছেনই!
আস/এসআইসু