আলোকিত সকাল ডেস্ক
ঋণখেলাপিদের গণহারে ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগ করে দেওয়ার উদ্যোগ চলছে। ছোট, মাঝারি বা বড় সব ঋণখেলাপিই পুনঃ তফসিলের সুযোগ পাবে। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীনতার পর যারা ঋণখেলাপি এবং টাকা পরিশোধ করেনি তারাও পুনঃ তফসিলের সুবিধার জন্য আবেদন করতে পারবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, পুরো বিষয়টি তদারক করবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে গত সপ্তাহে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সার্কুলার জারির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে এসব উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে ঋণখেলাপিদের একগুচ্ছ সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে তার কিছু বিষয় আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। কারণ শুধু ঋণখেলাপিদের বিষয় দেখলে হবে না, আমাদের ভালো ঋণগ্রহীতাদের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আর এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। মাস্টার সার্কুলারের বিষয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে খুব শিগগির আমরা মাস্টার সার্কুলার জারি করব। এমনও হতে পারে, এ সপ্তাহের মধ্যে আমরা সার্কুলারটি জারি করে দিতে পারি।’ সার্কুলার জারির পর ঋণ পুনঃ তফসিলের সুবিধা কার্যকর হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
সূত্রে জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে ঋণখেলাপিদের সার্কুলারের একটি জুতসই নাম দেওয়া হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভূত এবং নেতিবাচক প্রভাব হেতু দেশের প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন ব্যবসায়ী/শিল্পোদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ব্যাংকে অনিয়মিত ঋণসমূহ নিয়মিতকরণের লক্ষ্যে ব্যাংক দায় পরিশোধে নীতিগত সহযোগিতা প্রদানসহ ব্যাংক দায় পরিশোধ প্রক্রিয়া সহজীকরণ’।
সার্কুলারে ঋণখেলাপিদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলেছে, সার্কুলার মোতাবেক, ঋণখেলাপিদের ওপর অনারোপিত সুদ সম্পূর্ণ মাফ করে দেওয়া হবে। এই বিষয়টি হচ্ছে, ঋণখেলাপি হওয়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাংক হিসাব করেছে ঠিকই, কিন্তু তার সুদের হিসাব এখনো ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে তোলা হয়নি—এমন সুদ সম্পূর্ণ মাফ করে দেওয়া হবে।
আবার আরোপিত সুদের ক্ষেত্রেও খেলাপিরা বিশেষ ছাড় পাচ্ছে। খেলাপি ঋণের ওপর আরোপিত সুদের স্থগিত অংশ (সাসপেন্ডেড) মাফ পাবে খেলাপিরা। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমলেও ব্যাংকের তহবিল ব্যয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ঋণের সুদের মাধ্যমে তহবিল ব্যয় নির্বাহ করা হয়। আর এ আশঙ্কা দূর করতে ব্যাংকগুলোর কস্ট অব ফান্ডে (তহবিল ব্যয়) রিলিফ বা ছাড় দেওয়া হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলেছে, খেলাপিদের ঋণের সুদ হার গণনা হবে ৯ শতাংশ সরল সুদে। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিলেই ঋণ পুনঃ তফসিলের জন্য আবেদন করতে পারবে খেলাপিরা। ঋণ পরিশোধে এক বছর গ্রস পিরিয়ডসহ মোট ১৩ বছর সময় পাবে তারা। এই এক বছরে কোনো ঋণ পরিশোধ করতে হবে না।
ছোট, মাঝারি ও বড় ঋণ খেলাপির ধরন যা-ই থাকুক না কেন সবাই এসব সুবিধা নিতে পারবে। স্বাধীনতার পর থেকে যারা ঋণখেলাপি তারাও এ সুবিধার আওতায় আসবে। এ ক্ষেত্রে তাদের খেলাপি ঋণের হিসাব হবে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এককালীন হিসাবায়ন ভিত্তিতে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যত খেলাপি ঋণ আছে তার হিসাব করা হবে।
কোনো ঋণখেলাপি যদি মনে করে এককালীন ঋণ পরিশোধ করে খেলাপির তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে, তাহলে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে সার্কুলারে। বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে ঋণখেলাপিরা ঋণ পরিশোধের জন্য এক বছর পর্যন্ত সময় পাবে। এককালীন পরিশোধের জন্য ৯ শতাংশ হারে সুদ আরোপ করা হবে। সময় দেওয়া হবে ছয় মাস। এর মধ্যে পরিশোধ করতে না পারলে আরো ছয় মাস অতিরিক্ত সময় পাবে ঋণখেলাপিরা। যদি কোনো ঋণখেলাপি অতিরিক্ত সময়ের মধ্যেও পরিশোধ করতে না পারে তাহলে ৯ শতাংশ সুদের সঙ্গে আরো ২ শতাংশ সুদ আরোপ করা হবে। অর্থাৎ তখন সুদের হার হবে ১১ শতাংশ।
চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলেছে, সার্কুলার জারির পর থেকেই ঋণখেলাপিরা এতে উল্লেখ করা বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তবে এ জন্য সার্কুলার জারির ৯০ দিনের মধ্যে তাদের আবেদন করতে হবে। যে ব্যাংকে গ্রাহক খেলাপি হয়েছে সে ব্যাংকে তাদের আবেদন করতে হবে। আবেদনে গ্রাহককে কেন তার ঋণ খেলাপি হয়েছে তা উল্লেখ করতে হবে। কারণ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা এ সুবিধার বাইরে থাকবে। ৯০ দিন পর সার্কুলারের মেয়াদ শেষ বলে গণ্য হবে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে সার্কুলারের মেয়াদ বাড়তে পারে বলেও দায়িত্বশীল সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে।
সার্কুলার জারির পর ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক ভিত্তিতে খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদালতে যে মামলা হয়েছে তা স্থগিতের জন্য আবেদন করতে হবে। মামলা স্থগিতের আবেদন না করলে খেলাপিরা কোনো ধরনের সুবিধা পাবে না।
কোনো গ্রাহক ইচ্ছাকৃত খেলাপি কি না, ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা পাওয়ার যোগ্য কি না তা নির্ণয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটিতে অর্থ মন্ত্রণায়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং কয়েকটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে রাখা হতে পারে। ঋণ পুনঃ তফসিলের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ার হলেও এতে কাজ করবে মন্ত্রণালয় গঠিত এই কমিটি। গঠনের পর থেকে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, বরং এ কমিটিকে ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনঃ তফসিলের আবেদন অনুমোদনের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য পাঠাবে। কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো তা যাচাই-বাছাই করবে। পুনঃ তফসিলের জন্য যেসব ঋণকে যোগ্য মনে করবে কমিটি সেই ঋণের বিষয়ে একটি প্রস্তাব তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঠাবে। আর যেসব ঋণখেলাপি সরকারের দেওয়া এ সুবিধা নেবে না তাদের খেলাপি ঋণ আদায় করতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কম্পানি ব্যবস্থা নেবে।
ঋণখেলাপিদের গণহারে ঋণ পুনঃ তফসিলের এসব সুযোগের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বিআইবিএমের সাবেক ডিজি এবং অর্থনীতিবিদ তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর প্রয়োজন নেই। তাহলে শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ই থাকুক। এসব উদ্যোগ নেওয়া হলে ঋণ সংস্কৃতি ভেঙে পড়বে। ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর ব্যাংকিং খাতের সংস্কৃতি নষ্ট হলে মানুষের যাওয়ার আর জায়গা থাকবে না। দেশের শেয়ারবাজারের অবস্থাও খারাপ। এখন ব্যাংকিং ব্যবস্থাও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হবে সাধারণ মানুষের। তারা কোথায় যাবে? এগুলো ভালো উদ্যোগ নয়।
আস/এসআইসু