ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈরথ কোথায় নেবে বিশ্বকে?

আলোকিত সকাল ডেস্ক

ইরানের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলা করে তুলেছে মার্কিন প্রশাসন। এত দিন হোয়াইট হাউসের নেওয়া পদক্ষেপের বিপরীতে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে এক ধরনের সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিল তেহরান। কিন্তু এখন সেই নীরবতাও ভাঙল। ছয় জাতি চুক্তি থেকে আংশিক সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা। একই সঙ্গে ইরানকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত চুক্তিতে থাকা অন্য চার দেশ ভূমিকা না রাখলে ৬০ দিনের মধ্যে ইউরেনিয়ামের উৎপাদন আবার শুরু করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে তারা। অর্থাৎ বলটি এখন বিপরীত পক্ষের কোর্টে।

যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্য আপত্তিটি হচ্ছে ওই ছয় জাতি চুক্তিটি নিয়েই। পরমাণু কর্মসূচি সংকোচনের বিনিময়ে ইরানের ওপর থাকা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতির ওপর দাঁড়িয়ে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামের চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছিল ২০১৫ সালে। সাবেক বারাক ওবামা প্রশাসনের অন্যতম কৃতিত্ব হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়া এই চুক্তির ওপর শুরু থেকেই নাখোশ ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর দৃষ্টিতে এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের কাছে আত্মসমর্পণের দলিল।

প্রেসিডেন্ট হলে এই চুক্তি ছুড়ে ফেলবেন বলে কথা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কথা রেখেছেনও। গত বছরই যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি এই চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন। একই সঙ্গে আরোপ করেন বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা। বর্তমানে ইরানের দেশ শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই পদক্ষেপের কারণ হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন বলেছিল, আরও কার্যকর একটি চুক্তিতে তারা উপনীত হতে চায়।

ট্রাম্প প্রশাসন জেসিপিওএ চুক্তিকে ‘দুর্বল’ ঘোষণা করে আরও কঠোর ও কার্যকর পরমাণু চুক্তির কথা বললেও তার কোনো রূপরেখা এখনো দিতে পারেনি। এক বছর কিন্তু কেটে গেছে। কিন্তু হোয়াইট হাউস নিজের অবস্থানে অনড়। আর অনড় যে, তা বোঝাতেই রণতরী পাঠিয়েছে তারা, যা এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থির করে তুলেছে। ইরান সম্পর্কে হোয়াইট হাউসের অবস্থান কিছুটা স্পষ্ট হয় ফরেন পলিসিতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর লেখা একটি নিবন্ধ থেকে।

মাইক পম্পেওর ওই নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্র শুধু নয়, বিশ্বেরই বড় দুই সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে উত্তর কোরিয়া ও ইরানের কথা। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে পম্পেওর সুর কিছুটা নরম। কারণ, তাঁর দৃষ্টিতে ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সুযোগ্য ও দৃঢ় নেতৃত্বে একটি ঐতিহাসিক চুক্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে পিয়ংইয়ং ও ওয়াশিংটন।’ কিন্তু তিনি ইরানকে নিয়ে এখন পর্যন্ত এমন কোনো আশা দেখছেন না।

ইরানকে তিনি ‘দুষ্ট’ রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর ইরানের রেভ্যুলিউশনারি গার্ডকে তিনি দেখছেন ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে। শুধু পরমাণু কর্মসূচিরই নয়, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইরানের হস্তক্ষেপের সুস্পষ্ট সমালোচনা রয়েছে তাঁর নিবন্ধে। তেহরানের শাসকগোষ্ঠী থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের দুর্নীতি ও সম্পদের একটি খতিয়ানও তিনি ওই নিবন্ধে হাজির করেছেন।

মাইক পম্পেও তাঁর নিবন্ধে এমনকি ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে গত ডিসেম্বরে হওয়া বিক্ষোভের বিবরণ তুলে ধরে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, দেশটির শাসকেরা কতটা খারাপ। তিনি ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পেছনে ইরানের জনগণের প্রতি ওয়াশিংটনের সমবেদনাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি এটি বলতে ভুলে গেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত পদক্ষেপের কারণেই ইরানের অর্থনীতি এমন ভয়াবহ অবস্থায় এসে ঠেকেছে, যা দেশটির তরুণদের রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য করেছে। জেসিপিওএকে তিনি অকার্যকর ও দুর্বল বলে উল্লেখ করলেও, এটা বলেননি যে, এই চুক্তি সইয়ের দিন তেহরানসহ দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণেরা কেন উৎসবে মেতেছিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ইরান বিষয়ে একটি মহা-আলোচনায় বসতে চায়, যেখানে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর উপস্থিতি থাকবে। এই বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, ইরান-বিষয়ক আলোচনায় সৌদি আরব ও ইসরায়েলের প্রবেশাধিকার চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন চায়, শুধু পরমাণু কর্মসূচিই নয়, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প, সরকার ব্যবস্থাসহ সবকিছু আলোচনায় উঠে আসবে। হোয়াইট হাউসের এত বিপুল চাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে স্বাভাবিকভাবেই। বিষয়টি নিয়ে ফরেন পলিসির সানাম ভাকিলের নেতৃত্বে একটি জরিপ চালানো হয়। দশটি দেশের ৭৫ জন বিশ্লেষক ও নীতিপ্রণেতার কাছে প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প, হাসান রুহানিডোনাল্ড ট্রাম্প, হাসান রুহানিযুক্তরাষ্ট্র, ইরান, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইসরায়েল, রাশিয়া, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের বিশ্লেষক ও নীতিপ্রণেতারা এই বিশেষ জরিপে অংশ নেন। ট্রাম্প প্রশাসন যেমন মহা-আলোচনা চাইছে, ঠিক তেমন একটি বিস্তৃত পরিসরে এ জরিপ করা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, এই বহুজাতিক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের সবাই ট্রাম্পের পরিকল্পনা ও এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের সবাই এ পরিকল্পনার প্রথম যে ঘাটতিটি দেখিয়েছেন, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত পদ্ধতি। তাঁদের ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্র মুখে আলোচনার কথা বললেও বাস্তবে বলপ্রয়োগের নীতি অনুসরণ করছে। এই নীতির প্রতি ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন না থাকলেও ওয়াশিংটন তার অবস্থান থেকে নড়ছে না। ফলে এই নীতির কাজ করা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

ওয়াশিংটনের নীতি যে কাজ করছে না, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো ৯ মে পাওয়া গেল। ছয় জাতি চুক্তিতে থাকা ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতি ইরান যে আলটিমেটাম দিয়েছে, তা হিতে-বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই এখন প্রবল। বিষয়টি এরই মধ্যে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে রাশিয়া। মস্কোর পক্ষ থেকে তাই ইউরোপের দেশগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর আহ্বান জানান হয়েছে।

এদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দা হিল জানাচ্ছে আরেক তথ্য। ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ার মুহূর্তেই সংবাদপত্রটি মার্কিন প্রশাসনকে এই বলে সতর্ক করেছে যে, এমন পদক্ষেপের ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে রাশিয়া। দা হিল বলছে, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে রণডঙ্কা বেজে উঠেছে, তা মস্কোর কানে সুরের মতো লাগছে। কারণ এই উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে তারাই।

ইরানের তেল বিক্রিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা থেকে এরই মধ্যে দেশটি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। কারণ জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালির মতো বহু দেশ ইরান থেকে তেল কেনা কমিয়ে রাশিয়ামুখী হচ্ছে। এ ছাড়া পারস্য উপসাগরে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলের সমুদ্রপথের আবেদন বেড়ে যাবে। গত মাসে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড সম্মেলনেই মস্কো তাদের এই রুটটির গুরুত্ব তুলে ধরে বিস্তৃত বক্তব্য দিয়েছে। আবার ইরানের অস্ত্রের উৎস যেহেতু রাশিয়া, সেহেতু উত্তেজনা বাড়লে সামরিকীকরণের পথে আর্থিকভাবে মস্কো এমনিতেই লাভবান হবে। উপরন্তু ইরান, চীন ও ভেনেজুয়েলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ব্যস্ত হলে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোশিয়া অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তারের ভালো সুযোগ পেয়ে যাবে মস্কো।

কথা হচ্ছে এত কিছুর পরও ট্রাম্প প্রশাসন কেন ইরানের বিরুদ্ধে এমন উঠেপড়ে লেগেছে। প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কার বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে উঠেপড়ে লাগছে না? উত্তর হচ্ছে, সম্ভাব্য সবার বিরুদ্ধেই একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহ তৈরিতে তৎপর ওয়াশিংটন। ইরান, চীন, ভেনেজুয়েলা কেউ বাদ নেই এ তালিকায়। চীনের সঙ্গে চলছে বাণিজ্য যুদ্ধ। ভেনেজুয়েলায় সামরিক হস্তক্ষেপে কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে না বলে মত দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। আর ইরানের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে রণতরীর উসকানি। আর এই সবকিছুকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃঢ় নেতৃত্বের প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক, তা তো সবাই জানে। প্রশ্ন হলো যুদ্ধংদেহী এমন একটি মঞ্চায়ন কেন এত জরুরি হয়ে উঠল এ সময়। উত্তর খুঁজতে বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই সম্ভবত। শুধু মনে রাখলেই হয় যে, আগামী বছরই দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর সব সময় নিজেকে ‘গ্রেট ডিলমেকার’ দাবি করা ট্রাম্পের হাতে এমনকি উত্তর কোরিয়া চুক্তিটিও ধরা দেয়নি। ফলে নিজেকে শক্তিশালী হিসেবে তুলে ধরতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে আর কি বা আছে!

২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগের বছর সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ যেমন ইরাক আক্রমণ করে নিজের পক্ষে জনমত টানতে চেয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। ঠিক একই পথে হাঁটছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনিও নানা কারণ দেখিয়ে ইরান, ভেনেজুয়েলা ও চীনের সঙ্গে এমন একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করছেন, যার মূল লক্ষ্যই হলো জনগণকে এই বার্তা দেওয়া যে, ‘দেখ যুক্তরাষ্ট্র আবারও রাজ করছে। আর এই সংকটকালে প্রশাসনে বদল হওয়াটা উচিত নয়।’

আস/এসআইসু

Facebook Comments Box