আলোকিত সকাল ডেস্ক
বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে পরিকল্পনা থেকে মিশন সম্পন্ন হওয়ার মধ্যে ব্যবহার হয়েছে কয়েকটি মোবাইল ফোন ও ফেসবুক আইডি।
এর মধ্যে অন্তত ৩টি ফোন ও ১০টি আইডিতে খুনের যাবতীয় আলামত সংরক্ষিত আছে- এমন কথা বলছে পুলিশ। সঙ্গত কারণে পুলিশ এসব আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। মামলার নথিতে (কেস ডকেট) এক নম্বর আলামত হিসেবে একটি লাল মোবাইল ফোন সেটের কথা বলা হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রভাবশালী মহলের ইন্ধন ও শক্তিশালী হাতের ইশারা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কথা প্রচলিত।
কেউ কেউ বলছেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাঁচাতে মিন্নিকে ফাঁসিয়ে মামলা ভিন্ন খাতে নেয়া হচ্ছে। তবে এসব কথায় কান দিচ্ছে না পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি, রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি এ ঘটনার প্রধান পরিকল্পনাকারী। ০০৭ বন্ড গ্রুপের সদস্যদের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ ও কিলিং মিশন সফল করা হয়।
মামলার নথিতে যেসব কাগজপত্র উপস্থাপন করা হয় তাতে মিন্নিকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার নিু আদালতের রিমান্ড আদেশের সাটিফাইড কপি প্রকাশিত হয়।
এতে দেখা যায়, মিন্নির রিমান্ড চেয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে বলেছেন, ‘আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ের আগে মামলার এক নম্বর আসামি নয়ন বন্ডের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিষয়টি গোপন করে তিনি রিফাত শরীফকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরও নয়ন বন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নির বিবাদ হয়।
এ কারণে মিন্নি, নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী মিলে রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সেই মোতাবেক মিন্নি ঘটনার দিন ২৬ জুন রিফাত শরীফকে কলেজে নিয়ে আসেন।
রিফাতকে হত্যা করার জন্য ঘটনার আগে ও পরে অসংখ্যবার নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও আরিয়ান শ্রাবণের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন তিনি। তাছাড়া এ মামলার অন্যতম আসামি রেজওয়ান আলী খান ওরফে টিকটক হৃদয়ও তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেন।’
রিমান্ড আদেশে আদালত বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্যসহ নথি ও সিডি পর্যালোচনা করলাম। সিডি থেকে দেখা যায়, আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি ঘটনার আগে এবং ঘটনার পরপরই মামলার অন্যতম আসামি নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীদ্বয়ের সঙ্গে অসংখ্যবার মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন।
সিডি থেকে আরও দেখা যায়, ঘটনাস্থলে বরগুনা সরকারি কলেজ গেটে পুলিশের লাগানো সিসি ক্যামেরা ফুটেজে মিন্নির গতিবিধি সন্দেহজনক।’
আদালত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, মামলার অন্যতম আসামি রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দি দেন তাতেও মিন্নি অভিযুক্ত।
বিয়ের পরও আসামি নয়ন বন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নির সম্পর্ক খারাপ হয়- এমন তথ্য দেখা যায় তার জবানবন্দিতে। এমতাবস্থায় মিন্নিকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা সমীচীন মর্মে এ আদালত বিবেচনা করেন।
এক নম্বর আলামত লাল ফোন : মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জব্দ আলামতের গুরুত্বপূর্ণ অংশই প্রযুক্তিগত আলামত। এর মধ্যে আছে কয়েকটি মোবাইল ফোন, ফেসবুক আইডি, ইমেইল ঠিকানা ও মেসেঞ্জার গ্রুপ। তদন্ত কর্মকর্তা চার পাতার এই জব্দ তালিকা জুডিশিয়াল নথিতে সংযুক্তির আবেদন করেন।
জব্দ করা আলামতের এক নম্বর হচ্ছে একটি লাল রঙের স্যামসাং ক্যামেরা মোবাইল ফোন এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত ৩২ জিবি (গিগাবাইট) মেমোরি কার্ড।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই ফোনটির মাধ্যমে ০০৭ বন্ড গ্রুপটি চালানো হতো। গ্রুপের অ্যাডমিন ছিল আরিয়ান শ্রাবণ নামের এক কিশোর। মূলত বন্ড গ্রুপের মাধ্যমেই হত্যাকাণ্ডের আগের দিন অস্ত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে কিলিং মিশন সফল করা হয়। রিফাত খুন হওয়ার পর সবাইকে গা ঢাকা দিতেও বলা হয় এই মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে।
সূত্র বলছে, মামলার ২ নম্বর আলামতও মোবাইল ফোন। ধূসর রঙের ক্যামেরা মোবাইল ফোন সেটটির মডেল নম্বর স্যামসাং গ্যালাক্সি এ-৭।
এ ফোনটি ব্যবহার করতেন মামলার অন্যতম আসামি কামরুল হাসান সায়মুন। তার ফেসবুক আইডিও সন্দেহের তালিকায় প্রথম সারিতে আছে। তিন নম্বর আলামত আরও একটি সাদা মোবাইল ফোন।
শাওমি ব্র্যান্ডের ক্যামেরাযুক্ত এ ফোনটিতে যে সিমটি ব্যবহৃত হচ্ছিল তার নম্বর ০১৩১৭২৮৪২২৯। চার নম্বর আলামত হিসেবে আদালতে একটি ইউএসবি পেনড্রাইভ উপস্থাপন করা হয়। যাতে সন্দেহভাজন কয়েকটি ফেসবুক আইডির ডাটা সংরক্ষিত রয়েছে।
ফরেনসিকে ১০ ফেসবুক আইডি : পুলিশ বলছে, রিফাত খুনের প্রায় সব তথ্য-উপাত্ত ০০৭ বন্ড গ্রুপ ও ফেসবুকের মধ্যে লুকিয়ে আছে।
এজন্য ১০টি ফেসবুক আইডিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। যাতে কেউ মুছে ফেলতে না পারে, এজন্য আইডিগুলো থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ডাউনলোড করে রাখা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য দশ আইডির প্রথমেই আছে ০০৭ বন্ড গ্রুপের ফেসবুক আইডি। এর পরের অবস্থানে আছে এই গ্রুপের অ্যাডমিন শ্রাবণের ফেসবুক আইডি, যা খোলা হয় আরিয়ান শ্রাবণ নামে।
এছাড়া রেজওয়ান খান, রাব্বি আকন ও রিফাত ফরাজীর ফেসবুক আইডি এবং অ্যাকাউন্টের তথ্য-উপাত্ত ডাউনলোড করে সিআইডিতে পাঠানো হচ্ছে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সাইবার ফরেনসিকের তত্ত্বাবধানে বিশেষজ্ঞ দিয়ে এসব আলামত পরীক্ষা করতে হবে।
মামলার আলামত হিসেবে ০০৭ বন্ড গ্রুপের প্রোফাইল পিকচার, বিভিন্ন ফেসবুক স্ট্যাটাসের ১২টি সফট কপি এবং স্ট্যাটাস দেয়া ১১ সদস্যের প্রোফাইল পিকচারও নথিতে সংযুক্ত।
নথিতে এগুলোর রঙিন প্রিন্ট কপিও সংযুক্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আলামত হিসেবে উপস্থাপিত প্রযুক্তিগত এসব ডকুমেন্ট দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে কিনা- এমন প্রশ্ন করা হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর হুমায়ুন কবির মঙ্গলবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, মামলার মেরিট অনুযায়ী আমরা যেসব আলামত জব্দ করা প্রয়োজন মনে করেছি, তদন্তের স্বার্থে সেগুলোই জব্দ করা হয়েছে।
যেহেতু এসব আলামত জব্দ করা হয়েছে, সেহেতু এর সপক্ষে যথেস্ট যুক্তি তো আছেই আমাদের। তবে মিন্নিকে অভিযুক্ত করে পুলিশের উপস্থাপিত এসব তথ্য-উপাত্তকে বানোয়াট ও মনগড়া বলছে মিন্নির পরিবার।
বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার মেয়েটা অসুস্থ। তার চিকিৎসার জন্য আমরা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি। প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় আমার মেয়েকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় মিন্নির কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’ মিন্নির মা জিনাত জাহান মনি বলেন, মেয়েটাকে আমরা কারাগারে গিয়ে ঠিকমতো দেখতেও পারছি না।
বরগুনা কারাগারে মেয়েকে দেখতে গেলে ৫ মিনিটও ঠিকমতো কথা বলতে দেয়া হয় না। ডিবি পুলিশ পাশে দাঁড়িয়ে বারবার চলে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল। মেয়েটাকে রিমান্ডে এনে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়।
মিন্নির বাবা বলেন, কারাগারে মেয়েকে দেখে আমি প্রশ্ন করেছিলাম তুমি জবানবন্দিতে যা বলেছ তা কি সত্যি। মেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে আমাকে বলে, বাবা আমি পুলিশের শেখানো কথা বলে গেছি। না হলে আমার রক্ষা ছিল না।
মিন্নির বাবা আরও বলেন, কারাগারে বন্দি আমার মেয়ের সঙ্গে আমাদের কেন দেখা করতে দেয়া হবে না, এটা কেমন আইন। মেয়েটা অসুস্থ। তার চিকিৎসাও হচ্ছে না। আমি বারবার বলছি, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিন্নিকে এ ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছে। মিন্নি রিফাতের স্ত্রী হিসেবে এই মামলার বাদী হওয়ার কথা।
কিন্তু শুরুতেই ষড়যন্ত্র করে তাকে সরিয়ে অন্যকে বাদী করা হয়েছে। তাকে করা হয় প্রধান সাক্ষী। কিন্তু প্রধান সাক্ষীকেও গ্রেফতার করে আসামি বানাল। এটা গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ। আমি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এ মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাই। না হলে আসল রহস্য উন্মোচিত হবে না।
আমার নিরপরাধ মেয়েকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। কারাগারে মিন্নির সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাতে কড়াকড়ি আরোপের বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনার জেল সুপার আনোয়ার হোসেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, কারাবিধিতে স্বজনরা ৭ দিনে একবার বন্দির সঙ্গে দেখা করতে পারেন।
তবে আইনজীবী চাইলে যে কোনো সময়ই দেখা করতে পারেন। কোনো বন্দির সাক্ষাতে অতিরিক্ত কড়াকড়ি বা অন্য কিছু করার সুযোগ আমাদের নেই।
আস/এসআইসু