আলোকিত সকাল ডেস্ক
ছেলে ধরা সন্দেহে সারাদেশে অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি জেলায় ছেলে ধরা সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
গত এক সপ্তাহে রাজধানীসহ সারাদেশে ছেলে ধরা সন্দেহে নারীসহ সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নেত্রকোনায় এক ব্যক্তির কাছ থেকে নিহত শিশুর বিচ্ছিন্ন মাথা উদ্ধার করা হয়েছে। ক্ষুব্ধ জনতা তাকে পিটিয়ে মেরেও ফেলেছে। এতে করে রাজধানীসহ সারাদেশে ছেলে ধরা আতঙ্কে রয়েছেন অভিভাবকরা। প্রাইমারি ও হাইস্কুল এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রশাসন, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে রয়েছে উৎকণ্ঠা।
শনিবার রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে বোরখা পরিহিত এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। আজ শনিবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে উত্তর বাড্ডার কাঁচাবাজারের সড়কে এ ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বাড্ডা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে এক নারী গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। পুলিশ গিয়ে ওই নারীকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
স্থানীয়রা জানান, উত্তর বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা পাশাপাশি। সেখানে শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনজন বোরকা পরিহিত নারী যান। তারা স্কুলের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। বাধার মুখে দু’জন পালিয়ে গেলেও আরেকজন গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান।
অপরদিকে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক দুই স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে এক যুবক নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরো এক নারী। আজ শনিবার সকাল পৌনে ৯টায় ও বেলা পৌনে ১১টায় সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পূর্বপাড়া ও পাইনাদী শাপলা চত্বর এলাকায় এ দুই ঘটনা ঘটে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক সাখাওয়াত জানান, ৬-৭ বছরের এক মেয়ে শিশুর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ওই যুবক। এ সময় শিশুটি কান্নাকাটি শুরু করলে দুই যুবকের সন্দেহ হয়। তারা ওই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ করলে শিশুটি নিজের বলে দাবি করে ওই যুবক। ইতোমধ্যে শিশুটির বাবা ঘটনাস্থলে গেলে শিশুটি তার বাবার কাছে চলে যায়। এ ঘটনায় উপস্থিত লোকজন ওই যুবককে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জের খানপুর হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। নিহত যুবকের পরিচয় উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
অন্যদিকে শহরের শাপলা চত্বর এলাকায় ২২ থেকে ২৫ বছরের এক নারী খেলনা ও খাবার দিয়ে এক শিশুকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের সন্দেহ হলে তারা শিশুটি কার জিজ্ঞেস করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে এলাকাবাসী তাকে গণপিটুনি দেয়া শুরু করে। খবর পেয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার শারীরিক অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক শাহীদুল ইসলাম।
অপরদিকে ছয় থেকে সাত বছর বয়সী এক শিশুর কাটা মাথা ব্যাগে ভরে ঘোরাফেরা করার সময় নেত্রকোনা শহরের নিউ টাউন এলাকায় এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরের নিউ টাউন পুকুরপাড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এর আগে শিশুর কাটা মাথাসহ অজ্ঞাত ওই যুবক হরিজন পল্লী এলাকায় ঘোরাফেরা করছিল। বিষয়টি হরিজনদের দৃষ্টিগোচর হয়। পরে তাকে ধাওয়া করে নিউ টাউন পুকুরপাড়ে ধরে গণপিটুনি দেয়া হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ওই যুবকের মৃত্যু ঘটে।
নেত্রকোনা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম আশরাফুল ইসলাম জানান, গলাকাটা ওই শিশুর নাম সজীব মিয়া। তার বাবা রইস উদ্দিন পেশায় রিকশাচালক। তারা শহরের কাটলি এলাকার বাসিন্দা। সজীবদের গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার আমতলা এলাকায়। এবিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
গত ১৩ জুলাই রাজধানীর আদাবর এলাকায় গণপিটুনিতে মারা যায় এক যুবক। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, স্থানীয় নবোদয় হাউজিং এলাকায় ওই লোক সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাফেরা করছিল। এ কারণে লোকজন তাকে ছেলে ধরা হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে আটক করে। লোকজনের মারপিটে মারা যায় লোকটি।
অরপদিকে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুর ঘোনার কাঠালিয়া বাজারে গত ১০ জুলাই রাতে ছেলে ধরা সন্দেহে লোকজন অজ্ঞাত এক বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় ডুমুরিয়া থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ২ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। আটকরা হলেন স্থানীয় মেহেদী মোড়ল ও মধুসুধন মন্ডল।
ডুমুরিয়া থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বিপ্লব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে গ্রামবাসীর কাছে তিনি জানতে পেরেছেন।
এছাড়া সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলা শহরে ছেলে ধরা সন্দেহে অজ্ঞাত ৩০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি গণপিটুণিতে মারা গেছে।
অপরদিকে গতকাল শুক্রবার বান্দরবান জেলা শহরের বালাঘাটা এলাকার পাহাড়ি অঞ্চলে ছেলেধরা সন্দেহে এক রোহিঙ্গা তরুণীকে (১৮) পিটুনি দিয়ে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয়রা। আহত তরুণীর দাবি, তিনি ধর্ষণ থেকে বাঁচতেই পালাচ্ছিলেন। এক কিশোরকে দেখে তার সাহায্য পেতে ডাক দেন।
স্থানীয়রা জানায়, বালাঘাটার লেমুঝিরি ও অক্ষ্যংঝিরির মাঝামাঝি পাহাড়ে গরু চরাচ্ছিল বিজয় ইসলাম শুভ (১৫) নামের এক কিশোর। এ সময় আটক তরুণী ও আরও তিন তরুণ তাকে ধাওয়া করে। পরে কিশোরের চিৎকারে এলাকাবাসী ওই তরুণীকে ধরে ফেলেন।
এ বিষয়ে অক্ষ্যংঝিরির বাঙালি পরিবারের সন্তান কিশোর বিজয় ইসলাম জানায়, সে গরু চরানোর সময় হঠাৎ ওই তরুণী এসে তাঁকে ডাক দেয় এবং সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলে। কিন্তু সে যেতে অস্বীকার করলে তরুণী তাকে ধাওয়া করে। এ সময় আরও তিন তরুণ এসে তাকে ঘেরাও করার চেষ্টা করে। তখন সে চিৎকার দিলে তরুণ তিনজন পালিয়ে যায়। অন্যদিকে স্থানীয় লোকজন এসে পালানোর সময় পড়ে যাওয়া তরুণীকে ধরে ফেলে।
জানা গেছে, বান্দরবান সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই রোহিঙ্গা তরুণীর নাম রোকেয়া বেগম (১৮)। সে জানায়, সে ছেলেধরা নয়। থাকে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। বিবাহিত এ তরুণীর স্বামীর নাম হামিদ উল্লাহ। শরণার্থী শিবির থেকে চিকিৎসার জন্য বাবার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে গিয়েছিল।
রোহিঙ্গা তরুণীর তথ্য মতে, গতকাল শুক্রবার সকালে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হলে তিন যুবক তাকে ট্যাক্সিতে তুলে সরাসরি বান্দরবানে নিয়ে আসে। এরপর ওই পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে তারা তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। সে পালানোর চেষ্টা করার সময় পথে ওই কিশোরের দেখা পায় এবং কিশোরের কাছে সাহায্য চায়। কিন্তু কিশোরটি ভুল বুঝে চিৎকার দিলে এলাকাবাসী এসে তাকে ধরে ফেলে এবং পিটুনি দেয়।
রোকেয়া বেগম ভাষ্য মতে, যে তিন তরুণ তাকে চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানে নিয়ে আসে, তাদের নাম রহমত উল্লাহ, আয়াত উল্লাহ ও জাবেদ। তাদের নাম জানতে পারলেও তাদের ঠিকানা জানতে পারেনি সে।
বান্দরবান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা তরুণীকে চট্টগ্রাম থেকে কারা কীভাবে কী উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছে, তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। মারধরে তরুণীটি সামান্য আহত হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দেয়া হচ্ছে। এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তবে দেশব্যাপী যে ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে কান না দিয়ে এবং আতঙ্কিত না হওয়ার জন্যও সবার প্রতি আহ্বান জানান ওসি।
আস/এসআইসু