আলোকিত সকাল ডেস্ক
বড় ধরনের সংস্কারের আওতায় আসছে সঞ্চয়পত্র খাত। এরই অংশ হিসেবে পহেলা জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে সারা দেশে অনলাইনে লেনদেন। এছাড়া স্থাপন করা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের তথ্য সংক্রান্ত ডাটাবেজ।
পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের ক্রেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হচ্ছে কঠোর নীতিমালা। যার মধ্য দিয়ে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনায় নিরুৎসায়ী করা হচ্ছে।
এর ধারাবাহিকতায় আসন্ন বাজেটে (২০১৯-২০২০) তা কমিয়ে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে মাত্র ৩০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা চলতি বাজেটে ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের তুলনায় ১২ হাজার কোটি টাকা কম। তবে সঞ্চয়পত্রের বর্তমান সুদহার অপরিবর্তিত থাকছে। আর পুরনো সঞ্চয়পত্রধারীদের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
আরও জানা গেছে, সঞ্চয়পত্র খাতে কালো টাকা বিনিয়োগ রোধ, ধনী ও কর্পোরেট শ্রেণীর হাত থেকে সঞ্চয়পত্রকে রক্ষা, ঋণ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরানো ও অধিক সুদ পরিশোধে বাজেটের ওপর সৃষ্ট অতিরিক্ত চাপকে হ্রাস করতেই মূলত এই সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রাক-বাজেট বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদে হাত দেব না। সুদের হার কমাবো না। যাদের জন্য এটি চালু করা হয়েছে তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকবে। তবে এই খাতে কিছু সংস্কার করা হবে। কারণ কিছু অবৈধ টাকা এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে গত কয়েক বছর থেকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি। এটা কমিয়ে আনতে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এর পরপরই পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে শুধু ঢাকা শহরে চলতি মাস থেকে অনলাইনে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনা শুরু হয়েছে। প্রস্তাবিত নিয়ম অনুযায়ী, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ক্রেতাদের টিআইএন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও মোবাইল ফোন নম্বর সংযুক্ত করা। এতে সঞ্চয়পত্র কেনাবেচায় ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
চলতি মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক কো-অডিনেশন কাউন্সিল সভায় সঞ্চয়পত্র নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। যা আগামীতে সঞ্চয়পত্র খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে।
ইতিমধ্যে অনলাইনে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ঢাকায় শুরু করা হয়েছে। নতুন পদ্ধতি পুরনো সঞ্চয়পত্রধারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এদিকে আগামী ১ জুলাই থেকে সারা দেশে এ পদ্ধতি চালু করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত ১৫ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সরকারি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ কর্মসূচি বিভাগ থেকে জারি করা এ নির্দেশনায় বলা হয়, জাতীয় সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে জেলা শহরে সঞ্চয়পত্র স্কিম লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের সব কার্যালয় ও শাখাকে লেনদেন শুরু করতে হবে। আগামী পহেলা জুন থেকে অনলাইন ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতির বাইরে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনা না করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
সঞ্চয়পত্র অধিদফতর নূত্রে জানা গেছে, চলতি (২০১৮-১৯) অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে ৬৮ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ বেশি। আর এর ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল, তার চেয়েও ৫২ শতাংশ বেশি নিয়ে ফেলেছে নয় মাসেই।
প্রসঙ্গত সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের কমপক্ষে প্রতি দুই মাস অন্তর সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। সে হিসাবে জুলাই-মার্চ- এ সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি ২১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের বিপরীতে গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২১ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা সুদ গুনতে হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ হার সবচেয়ে বেশি নির্ধারণ করেছে। মূলত সমাজের পেনশনভোগী, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে এখান থেকে সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ সুদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ এতটাই বেড়ে গেছে যে, বর্তমানে বছরে এ ঋণের সুদ-আসল বাবদ সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তার থেকেও এ ব্যয় এক হাজার কোটি টাকা বেশি। তাই শিগগিরই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের লাগাম টানতে চায় সরকার। এ জন্য এ খাতে বিনিয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, সংস্কারের আরও একটি অংশ হচ্ছে আগামীতে সঞ্চয়পত্র বেচাবিক্রিতে সংকুচিত করা। যে কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ঘাটতি বাজেট পূরণে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। এ খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি বাজেটে ধরা হয়েছে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বাজেটের তুলনায় আগামী বাজেটে এই খাত থেকে ১২ হাজার ২৯ কোটি টাকা কম নেয়া হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএস’র সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বেশি থাকার কারণে সরকারকে বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয় এ খাতে। এতে বছর শেষে সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে বড় অঙ্কের টাকা চলে যায়। যা শেষ পর্যন্ত বাজেটের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। বাজেটকে কিছুটা চাপমুক্ত করতে সঞ্চয়পত্র থেকে কম টাকা নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়া এ খাতে সুদ হার বেশি হওয়া ব্যাংকের আমানতকারীরাও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। এতে ব্যাংকগুলোতে এক ধরনের তারল্য সংকট হচ্ছে।
আস/এসআইসু